শরবত বিক্রি করে চলে কাওছার মিয়ার সংসার

ফরিদ মিয়া প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট , ২০২৫ ১৫:১৭ আপডেট: ২৭ আগস্ট , ২০২৫ ১৫:১৭ পিএম
শরবত বিক্রি করে চলে কাওছার মিয়ার সংসার

জীবন মানেই সংগ্রাম—এ কথার জীবন্ত উদাহরণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাওছার মিয়া। প্রায় দুই দশক ধরে তিনি হেঁটে হেঁটে শরবত বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। দিনে রোদ, বৃষ্টি কিংবা শীত—কোনো কিছুই থামাতে পারে না তাঁর পথচলা। কারণ, তাঁর কাঁধে শুধু একটি সংসারের দায় নয়, বরং ছয় সদস্যের পুরো পরিবারের দায়িত্ব।
কাওছার মিয়ার সংসারে সদস্য সংখ্যা ছয় জন। স্ত্রী ও তিন সন্তানের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে তিনি শরবতের গ্লাসে ভরসা রেখেছেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে পড়াশোনা করছে। তাঁদের লেখাপড়া থামিয়ে দিতে চান না কোনোভাবেই। তাই প্রতিদিন ভোরে উঠে শরবত তৈরির কাজ শুরু করেন, এরপর ভারে বালতি ঝুলিয়ে  নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পথে।
শরবত বিক্রির দীর্ঘ যাত্রা
প্রায় ২০ বছর ধরে শরবত বিক্রি করছেন কাওছার মিয়া। শুরুটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে হলেও কাজের টানে তিনি ঘুরেছেন নানা জায়গায়। প্রথমে ময়মনসিংহ শহরে চার বছর, পরে কুমিল্লায় পাঁচ বছর শরবত বিক্রি করেছেন। আর গত ১১ বছর ধরে নান্দাইলেই তাঁর জীবিকা গড়ে উঠেছে। নান্দাইলের মানুষও তাঁকে চিনে ফেলেছে ‘শরবতওয়ালা কাওছার’ নামে।
তিনি প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ২৬০ গ্লাস শরবত বিক্রি করেন। প্রতি গ্লাসের দাম ১০ টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বিক্রি বেড়ে যায়, আবার শীতল বা মেঘলা দিনে তা কমে যায়। তবে গড়ে তিনি প্রতিদিন ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকার শরবত বিক্রি করতে সক্ষম হন।
শরবতের উপাদান ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
কাওছার মিয়ার শরবত শুধু তৃষ্ণা মেটানোর পানীয় নয়, বরং প্রাকৃতিক ভেষজ উপাদানে তৈরি একধরনের স্বাস্থ্যকর পানীয়। তাঁর শরবতে থাকে—
এলোভেরা (ঘৃতকুমারী),শিমুলের মূল,উলটকম্বল,বেল সুট,ত্রিফলা,ইসবগুলের ভুষি,চিরতাওচিনি।
এই ভেষজ উপাদানগুলো দিয়ে তিনি প্রতিদিন শরবত তৈরি করেন। তাঁর শরবত শুধু তৃষ্ণা নিবারণ করে না, বরং ভোক্তাদের কাছে স্বাস্থ্যকর হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
সংসারের হিসাব-নিকাশ
১০০০ টাকা খরচ হয়। এছাড়া চলাফেরা, সংসার খরচ ও বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ মেটাতে তাঁকে কষ্টকর হিসাব কষতে হয়।
তবুও তিনি চেষ্টা করেন প্রতিদিন কিছু টাকা সঞ্চয় করতে। কারণ তিনি জানেন, ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ আরও বাড়বে।
সমাজে শরবতওয়ালার গুরুত্ব
গরমের দিনে শহর কিংবা গ্রামীণ বাজারে শরবতওয়ালার ডাক যেন এক আশীর্বাদ। অল্প দামে তৃষ্ণা মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যকর পানীয় পাওয়া যায় বলে মানুষজন খুশি মনে কিনে পান করে। নান্দাইলের মানুষও কাওছার মিয়ার শরবতের উপর আস্থা রেখেছেন। তাঁর গ্রাহকেরা বলেন, “কাওছার ভাইয়ের শরবত শুধু সুস্বাদুই নয়, বরং শরীর ঠাণ্ডা রাখে। গরমে ক্লান্তি দূর করতে এর জুড়ি নেই।”
সংগ্রামী জীবনের গল্প
কাওছার মিয়া জানান, তাঁর জীবনে নানা ঝড়ঝাপটা গেছে। শুরুতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। বৃষ্টির দিনে বিক্রি কমে গেলে কখনো সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়েছে। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। ধৈর্য আর কঠোর পরিশ্রমই তাঁকে আজ এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
তিনি বলেন,
“শরবত বিক্রি আমার কাছে শুধু ব্যবসা নয়, বরং জীবনের ভরসা। এই শরবতের গ্লাসেই আমার সংসারের আলো জ্বলে। সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারছি। আশা করি ওরা বড় হয়ে ভালো মানুষ হবে।”
পরিবর্তিত সমাজে এক অচেনা নায়ক
আজকের ব্যস্ত নগরজীবনে মানুষ দৌড়াচ্ছে প্রাইভেট চাকরি, ব্যবসা কিংবা বিদেশমুখী কর্মসংস্থানের জন্য। কিন্তু কাওছার মিয়ার মতো মানুষদের গল্প তেমন আলোচিত হয় না। অথচ তাঁর মতো মানুষ প্রতিদিন সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে স্বল্প খরচে পরিশ্রমের বিনিময়ে স্বাস্থ্যকর পানীয় সরবরাহ করছেন।
সমাজে তাঁরা একধরনের অচেনা নায়ক, যাদের অবদানকে আমরা অনেক সময় অবহেলা করি।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন কাওছার মিয়া চান, একদিন তাঁর ছেলে-মেয়েরা ভালোভাবে লেখাপড়া শেষ করুক। তিনি আশা করেন, তাঁদের কেউ চাকরি বা ব্যবসা করবে। তখন হয়তো তাঁর কাঁধের বোঝা কিছুটা কমবে। তবে তিনি নিজে শরবত বিক্রি ছাড়তে চান না, কারণ এটি তাঁর পরিচয় হয়ে গেছে।
কাওছার মিয়ার জীবন কেবলই সংগ্রামের গল্প নয়; এটি পরিশ্রম, সততা আর অধ্যবসায়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সমাজে যদি প্রতিটি মানুষ তাঁর মতো ইমানদারি আর শ্রম দিয়ে কাজ করে, তবে জীবন কঠিন হলেও তা সুন্দর হয়ে উঠতে পারে।
রোদে-ঝড়ে, ধুলো-বৃষ্টিতে পথ চলা এই মানুষটির শরবতের প্রতিটি গ্লাস শুধু পানীয় নয়, বরং একটি পরিবারের হাসি-খুশি বাঁচিয়ে রাখার হাতিয়ার। কাওছার মিয়া প্রমাণ করেছেন, ছোট্ট পেশাও বড় স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখতে পারে।

এই বিভাগের আরোও খবর

Logo