ভোলায় অবাধে চলছে চিংড়ির রেণু শিকার, হুমকিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী

 সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ভোলার ৭ উপজেলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতে প্রতিদিন অবাদে শিকার করা হচ্ছে গলদা ও বাগদা চিংড়ির রেণু। এসব চিংড়ির রেণুর সঙ্গে নির্বিচারে ধ্বংস হচ্ছে শতাধিক প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী। চিংড়ির রেণু ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য। নেই পর্যাপ্ত নজরদারি, তবে কঠোর অবস্থানের দাবি মৎস্য বিভাগের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিল থেকে জুন এ ৩ মাস চিংড়ির রেণুর ভরা মৌসূম। জেলেরা নদী থেকে বাগদা ও গলদা চিংড়ি রেণু আহরণের পর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জেলেদের কাছ থেকে প্রতি ১ হাজার চিংড়ি রেণু ক্রয় করেন মাত্র ৯শ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১শ’ টাকায়। এরপর ব্যবসায়ীরা এসব চিংড়ি খুলনা সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ড্রামে করে কৌশলে পাচার করে প্রতি হাজার চিংড়ি রেণু বিক্রি করেন ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। ভোলার গলদা ও বাগদা চিংড়ি দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় চাহিদাও রয়েছে বেশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীতে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চিংড়ির রেণু শিকার। নদীতে অবৈধ মশারি জাল দিয়ে চিংড়ি রেণু শিকারের সময় জেলেদের জালে উঠে আসছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের রেণু ও জলজ প্রাণী।
মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে চিংড়ির রেণু পোনার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৮ জনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতের মধ্যে লালমোহন উপজেলার ৫ জন, দৌলতখানের ২ জন ও ভোলা সদর উপজেলার ১ জন ব্যবসায়ী রয়েছে। এছাড়া ১ কোটি ৮০ লাখ চিংড়ির রেণু জব্দ করে নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে।
ভোলা সদরে উপজেলার তুলাতুলি, কাঠির মাথা, ভোলার খাল, দৌলতখান উপজেলার মেদুয়াসহ মেঘনা নদী তীরবর্তী কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলেরা মশারি জাল দিয়ে নদী থেকে চিংড়ির রেণু ধরছে। কিছুক্ষণ পর পর জাল নিয়ে জেলেরা নদীর তীরে উঠে এসে চিংড়ির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেণু ‘চা চামচ এবং ঝিনুক’ দিয়ে বেছে (বাছাই) করে নির্দিষ্ট পাত্রে রেখে অন্যান্য মাছের পোনা ও জলজ প্রাণী মাটিতে ফেলে দিচ্ছেন। এতে মারা যাচ্ছে অন্যান্য মাছের পোনা ও জলজ প্রাণী। তবে জেলেদের দাবি পেটের দায়ে বাধ্য হয়েই তারা চিংড়ির রেণু শিকার করেন।
জেলে মো: কাঞ্চন, মো: রফিক ও সোহাগ বলেন, চলতি বছরে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে ২ মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে অনেক আশা ছিল নদীতে গিয়ে ইলিশসহ সব ধরনের বেশি পরিমাণে মাছ পাব। কিন্তু হয়েছে উল্টো, নদীতে মাছ কম। নদীতে এখন প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি রেণু পাওয়া যায়। তাই আমরা বাধ্য হয়েই নদী থেকে চিংড়ির রেণু ধরি। না ধরলে আমাদের সংসার চলে না, কি করব ? আমরা রেণুগুলো স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি পিচ প্রায় ১ টাকা করে বিক্রি করি। একেকজন জেলে দৈনিক ৫০০ থেকে দেড় হাজার পিস চিংড়ি রেণু শিকার করতে পারেন বলেও জানান তারা।
চিংড়ির পোনা ধরার কারণে অন্যান্য মাছের পোনা ও জলজ প্রাণী ধ্বংসের বিষয়টি স্বীকার করেন কয়েক জন জেলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, নদীতে মশারি জাল টেনে উপরে তোলার পর দেখা যায় বিভিন্ন মাছের পোনা উঠেছে। পরে চিংড়ির পোনা রেখে বাকিগুলো নদীতে ফেলে দেই। তবে অধিকাংশ জেলেই চিংড়ি রেণু ব্যতীত অন্যান্য মাছের রেণু ও জলজ প্রাণীর বিষয়ে উদাসীন। সেগুলো তারা এদিকে-সেদিক ফেলে দেয়ার কারণে মরে যায়।
জেলে সমিতির পক্ষ থেকে জেলেদের নিরুৎসাহিত ও সচেতন করা হচ্ছে, কিছুই কাজে আসছে না জানিয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও মৎস্যজীবী জেলে সমিতি ভোলার সাধারণ সম্পাদক মো: এরশাদ ফরাজি বলেন, গত ২ মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে নদীতে কাঙ্খিত মাছ না পাওয়ায় জেলেরা অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছেন। ফলে রেণু চিংড়ি ধরে কিছুটা অভাব দূর করার চেষ্টা করছেন তারা। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে জেলেদের প্রশিক্ষণ বা সচেতনতা বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করলে চিংড়ির রেণু শিকার থেকে বিরত রাখা সম্ভব হতো। তিনি আরো বলেন, একটি চিংড়ি রেণু ধরতে গিয়ে অন্যান্য প্রজাতির আরও একশ প্রজাতির পোনা ধ্বংস করছে।
নদীতে রেণু পোনার পরিমাণ যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশি। চিংড়ি রেণু শিকারীদের মধ্যে ৯০ ভাগই শিশু ও নারী। ফলে তাদের ক্ষেত্রে আইন বাস্তবায়ন করা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও অভিযান পরিচালনা করে আহরিত চিংড়ি রেণু আটক করে ফের নদীতে অবমুক্ত করা হচ্ছে বলে জানান, ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব। তিনি বলেন, চলতি মৌসূমে কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ চিংড়ি রেণু পোনা আটক করা হয়েছে। যে সব অসাদু ব্যবসায়ীরা জেলেদের চিংড়ির রেণু ধরতে উৎসাহিত করছে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনছি। ইতোমধ্যে ৮ জন অসাধু ব্যবসায়ীকে আটক করছি এবং তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা চলছে। আমরা চেষ্টা করছি রেণু চিংড়ি আহরণ বন্ধ করতে। জেলেরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকাতে চিংড়ির রেণু শিকার করে এবং এ ব্যবসাটা ভ্রাম্যমাণ। তারপরও আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। এদিকে ভবিষ্যতে নদীতে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে অতিদ্রুত চিংড়ি রেণু শিকার পুরোপুরি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন ভোলার সচেতন মহল।